রুমা মোদক
একমাত্র পুত্রের মৃত্যুশোক ছাপিয়ে কুলমান রক্ষার দায় বড় হয়ে উঠার যন্ত্রণা যে কঠিন দমবন্ধতা তৈরি করে তারও একটা তুলনীয় যন্ত্রণা খুঁজে পায় মনোয়ারা। আব্দুল হাকিম যেদিন তার গলা টিপে ধরেছিল। বেঁচে থাকা আর বেঁচে না থাকার মধ্যে মূহুর্তের পার্থক্য।সেই পার্থক্য ছাপিয়ে দম বের হওয়া না হওয়ার অবর্ণনীয় যন্ত্রণা। একমাত্র পুত্র রেহানউদ্দিনের মৃত্যুর পর মনোয়ারার জীবনে সেই যন্ত্রণাটারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসে নিয়মমাফিক সামাজিক রীতি মেনে সান্ত্বনার বাণী নিয়ে। আসতে হয় তাদের। তারা যেমন জানে মনোয়ারাও জানে এসব সান্ত্বনার মুখস্থ বাণী বলা নিয়ম। যা কোনভাবেই কারো কোন শূন্যতাই পূরণ করে না। বেঁচে থাকা বাকি দিন পুত্রশোকের পাথর বুকে চেপে বেঁচে থাকার থৈহীন জীবনে তাকে হাবুডুবু খেতে হবে। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে খেতে হবে,প্রাকৃতিক ঘুম এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে শ্রান্ত দেহে। আর খেতে খেতে ঘুমাতে ঘুমাতে তার হঠাৎ মনে হবে আহারে কী কষ্ট পেয়েই না মারা গেছে ছেলেটা। কী নির্দয় মারের দাগ তার সারা গায়ে। ঠোঁটের পাশে, চোখের নিচে জমাট বেধে আছে প্রচণ্ড ঘুষির কালসিটে রক্ত। আহারে ছেলেটা বোধহয় একটু পানি খেতে চেয়েছিলো। আহা ছেলেটা সেই শৈশবে খেলতে খেলতে ঘেমে গেলে কী যত্নেই না আঁচলে মুছে দিতেন ঘাম। বাটিতে সরিষার তেল কালোজিরা দিয়ে গরম করে ডলে ডলে মেখে দিতেন সারা গায়ে। চকচক করতো গায়ের চামড়া, হাতের পেশি। আহারে সেই ছেলেটা…।
পুত্রশোকের বিহবল দশা তাকে বিবশ করে দেয়ার আগেই সে ধড়ফড় করে উঠতো ভয়ে শংকায়। আগতরা এখনই রেহানের বউকে একবার দেখতে চাইবে। ঘটতোও ঠিক তাই। বউ অসুস্থ। রেহানকে হারিয়ে তার মাথা ঠিক নেই, ডাক্তার ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে ইত্যাদি নানাবিধ অজুহাতে বঊকে তিনি আড়ালে রাখেন। কারও সামনেই আসতে দেননা৷ কথাগুলো কেউ অবিশ্বাস করেনা। বিয়ের ছমাসের মাথায় স্বামী হারালে কারই বা মাথা ঠিক থাকে। এ এক মহাযন্ত্রণা হয়েছে তার জন্য। ছেলের শোক সামলাবেন না এই উৎকট ঝামেলা সামলাবেন!
টিনের চালায় কাঁচা আম পড়ার শব্দটা এই রাতে প্রবল বিস্ফোরণের মতো বাজে।এই মূহুর্তে বাসাভরতি মানুষের কারো কানেই শব্দটা পৌঁছে না। কিন্তু মীরার কাছে এই বীভৎস আওয়াজ স্মৃতির খুব কাছেধারে আর কোন আওয়াজের সমকক্ষ মনে হয়না। মধ্যরাত পাড় হয়ে যাওয়া এই নবাগত ভোরটুকু পাড়ি দেয়াই সবচেয়ে কঠিন হয়ে পড়ে নির্ঘুম রাতগুলোতে। সবার শরীর ক্লান্তিতে পরাজিত হয়ে ঝিমিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিলো সব অপেক্ষা, উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা অগ্রাহ্য করে। তখনই শব্দটা হয়। মীরা ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠে।
এক লাফে দরজা খুলে বাইরে যায় মীরা। যে যেখানে ঝিমুচ্ছিল,কেউ চেয়ারে, কেউ সোফায়, কেউ বিছানায় বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে কেউ টের পায়না। মীরা শুধু ঝটকায় ঝিমানো ঝেড়ে বাইরে যায়। হ্যা রেহান এসেছে। রেহানই। এ নিয়ে সন্ধ্যা থেকে বার দশেক দরজা খুলে বাইরে এসেছে সে। কলিং বেল বাজলে কিংবা একটু জোর হাওয়া দরজায় ধাক্কা দিলে সে দৌড়ে বের হয়েছে রেহান এসেছে ভেবে। প্রতিবার প্রতারিত হয়েছে মীরা। এবার সত্যি রেহান ফিরেছে। রেহান। মীরা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা। চিৎকার করে জানান দিতে চায় দিনভর উৎকণ্ঠা আর অপেক্ষায় থাকা সবাইকে।
আসলে সারা দিনে একে একে সবাই আসতে আসতে এখন বাসা ভরতি মানুষ। শহরে যতো আত্মীয় স্বজন পরিজন, বন্ধু বান্ধব, পরিচিতজন। যে যেখান থেকে খবর পেয়েছে ছুটে এসেছে। যে যেভাবে পারে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেছে। যে যেদিকে পারে খোঁজে বেরিয়ে গেছে। সারাদিন সি এন জি চালিত অটোরিকশায় মাইক বেঁধে আশেপাশের এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে, নিখোঁজ সংবাদ…। নিখোঁজ সংবাদ…। মধ্যরাত পর্যন্ত সবাই অপেক্ষায় ছিলো রেহান ফিরবে।একে একে সবার সব চেষ্টা ব্যার্থ হতে থাকলে পরাজিত সৈনিকের মতো ফিরছিলো সবাই। মধ্যরাতের পর মীরার উন্মাদের মতো আচরণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে কাছের ক্লিনিক থেকে ডাক্তার ডেকে এনে প্যাথেড্রিন ইঞ্জেকশন পুশ করা হয় মীরাকে । কিন্তু সবাই সারাদিনের ক্লান্তির কাছে হার মেনে ঘুমে ঢুলঢুল করলেও ইঞ্জেকশনেও ঘুম আসেনি মীরার।
২৪ ঘন্টা পার হয়েছে রেহান বাসায় ফিরেনি। গতকাল সন্ধ্যায় কার ডাকে যেনো মা আমি একটু আসছি বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। তারপর কাল সারারাত, আজ সারাদিন গিয়ে সন্ধ্যা পাড় হয়ে মধ্যরাত।রেহান ফিরেনি। মোবাইল ফোনটাও বন্ধ।মীরা আর মনোয়ারার ফোনে সেইভ করা রেহানেরর সব কয়টা বন্ধুর নাম্বারে কল করা হয়েছে। কেউ রেহানের কোন খবর জানাতে পারেনি।
তৃষা নামের এক মেয়ের নাম্বার দিলো কেউ একজন। রেহানের বন্ধু। অন্যরকম সম্পর্কের ইংগিত দিয়ে বলছিলো তৃষার কাছে খোঁজ নিতে। তৃষা ফোন ধরেই বললো,হ্যা রেহান বলো। স্পষ্টই বুঝা গেলো রেহানের স্ত্রীর নাম্বার থেকে যাওয়া কলে রেহানের কণ্ঠ শোনার স্বাভাবিক প্রত্যাশাই ছিলো তৃষার। হয়তো কোন কারণে স্ত্রীর নাম্বারটা দিয়েছিল রেহান তাকে। কিন্তু তৃষার প্রত্যাশার স্বর নিশ্চিত করেই সাক্ষ্য দেয় রেহানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিতই কিছু জানেনা সে।
আব্দুল হাকিম, রেহানউদ্দিনের বাবা তখনও থানায় বসা। মধ্যরাতে থানার ওসি ফোন করে আনিয়েছে তাকে। মনোয়ারা একা ছাড়েনি আব্দুল হাকিমকে। সাথে বড় বোনের ছেলে আমানকে দিয়ে দিয়েছে। ওসি কেন ডেকেছে কী বৃত্তান্ত ফোনে কিছুই বলেনি খোলাসা করে। থানায় পৌঁছে ওসিকে আর পায়নি আব্দুল হাকিম। বেরিয়ে গেছে সে। তার কতো হাজারে বিজারে কাজ। নিখোঁজ হওয়া এক প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের খবর এতো গুরুত্বপূর্ণ নয় যে এর জন্য সব কাজ ফেলে তাকে থানায় বসে থাকতে হবে। কর্তব্যরত এস আই সামনে রাখা চেয়ারে তাকে বসতে বলে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে।
আব্দুল হাকিম টের পায় ছেলে নিঁখোজ হবার ফলে তার জীবন ঘিরে যে অসহনীয় অবস্থা, বাকি পৃথিবীর প্রয়োজনের কাছে তা একেবারেই তুচ্ছ। এস আইয়ের ফোনে বিচিত্র কারণে ফোন আসে। এস আই মোটা এক রেজিস্ট্রি খাতায় কী সব লিখতে থাকার ব্যস্ততা থেকে ভ্রু কুঁচকে প্রবল বিরক্তিতে ফোনের দিকে তাকায় আর ততোধিক বিরক্তিতে বলে,হ্যালো। প্রতিবারই আব্দুল হাকিমের মনে হয় নিশ্চয়ই রেহানের খবর। কিন্তু না। অন্য লোক, অন্য প্রসঙ্গ। বসতে বসতে অসুস্থ লাগতে থাকে তার। চোখে সামনের সবকিছু অস্পষ্ট ঘোলা। বিবমিষা। অনেক কষ্টে বমি আটকায় সে। এক গ্লাস পানির তৃষ্ণায় সামনের সব ধু ধু মরুভূমি বোধ হয় নিমিষে নিমিষে। কাকে বলবে পানির কথা? খিদে আর শ্রান্তি ততোক্ষণে গ্রাস করে নিয়েছে সব উৎকণ্ঠা। সুনসান থানা চত্ত্বরে দুয়েকজন পুলিশ কন্সটেবল দায়িত্বের খাতিরে এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছে,তাদের দৃষ্টিতে ঘাপটি মেরে আছে রাজ্যের বিরক্তি আর উপেক্ষা। আমান বারান্দার এক কোণে বসে আছে মাথা চেপে ধরে। কাকে সে বলে এক গ্লাস পানির কথা!
এস আই, শার্টের ব্যাজে নাম লেখা ‘আহমেদ’, প্রতিটি ফোন ধরে ধমকে উঠে,বলে, তারপর কী বলেন। সীমান্তে দুই ট্রাক ফেন্সিডিল আটকা পড়েছে। ফাঁড়ি পথে শহরে ফেরার সময় সি এন জি উলটে গেছে। এক লোক হাঁফাতে হাঁফাতে এসে জানায় তার বাইক ছিনতাই হয়ে গেছে। অফিস রুমের এক কোনায় কম্পিউটারের স্ক্রিন। একজন পুরুষ ঘরের এক কোনায় ঘাড় গুঁজে বসে আছে। সেই রাতদুপুরে আব্দুল হাকিমকে ডেকে এনে বসিয়ে রাখলেও এখনো পর্যন্ত কিছুই বলেনি এস আই।আর কতোক্ষন বসে থাকতে হবে তাও জানেনা আব্দুল হাকিম। চোখ জড়িয়ে আসে। দেখতে পান শিশু রেহানের সামনে মনোয়ারার গলা টিপে ধরেছে সে, আর রেহান তার পা ধরে চিৎকার করে বলছে, আব্বা আব্বা আম্মুরে মাইরো না…। ধড়ফড়িয়ে জেগে বসে আব্দুল হাকিম। নিজের বদমেজাজের অসহ্য আগুনে পুড়েছে তার ত্রিশ বছরের সংসার। মনোয়ারা ধৈর্য ধরলেও হয়তো সংসারটা এমন নরক হতোনা। কিন্তু বিনা উত্তরে একটা কথা মাটিতে পরতে দিতো না মনোয়ারাও। চড়, থাপ্পড় খেয়েও সাবুদ নয় সে, কোমরে কাপড় গুঁজে কথার উত্তর না দিলে বদহজম রোগে ভুগতো সে। আহারে মনোয়ারার সাথে ঝগড়া লাগলেই চিৎকার শুরু করতো ছেলেটা। ভয়ে, অনিরাপত্তায়। ছেলেটার করুণ, অসহায় চেহারাটা এই মূহুর্তে বারবার ঘুমে ভারী হয়ে আসা চোখের পাতা গ্রাস করে আর্তনাদ করে উঠে। বুক ভেঙে কান্না আসে তার। বাপ মা ঝগড়া করলে যে ছেলে ঘুমাতো না ভয়ে সেই ছেলে কিনা শহরে মাদক সম্রাট হিসাবে পরিচিত? পুলিশের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড? গনি, শহরের আরেক মাদক ব্যবসায়ী অবশ্য অন্য কথা বলে। রেহানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী নাকি সেই। মোস্ট ওয়ান্টেড! আমরা বখরা না দিলে শালাদের বছরের এ মাথা ও মাথা কক্সবাজার যাওন লাগতো না। উত্তরা, নিকেতনে ফ্ল্যাট কিন্না পুলা মাইয়ারে ম্যাপল লিফ স্কুলে পড়ানি লাগতো না। হালার পুতেরা আমরার টেকায় খায় ঘুমায় হাগে মুতে আর আম্রারে কয় মোস্ট ওয়ান্টেড! আচ্ছা বখরার টাকা কম দেয়াতে কী কোন অঘটন? কিংবা ভাগ বাটোয়ারায়? এমন সম্ভাবনা গনি ফু মেরে উড়িয়ে দেয়। এমুন কুস্তা অইলে আমি হক্কলের আগে জানতাম চাচা। তবে গেলো কই রেহান? কই হারালো? আব্দুল হাকিমের প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেনা গনি।
মীরা দরজা খুলে রেহানকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়তেই রেহান মীরার মুখ চেপে ধরে। চুপ চুপ। সবাই ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। সারাদিনের অসহ্য যাপনের পীড়ন থেকে মুক্তি পেয়ে মীরার চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। ফিরেছে রেহান ফিরেছে। ইস! কী ধকলটাই গেছে গত ২৪ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে।
ঘরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দেয় রেহান। কেউরে কিচ্ছু কইও না মীরা।চুপ! একদম চুপ। র্যাব আমারে খুঁজতাছে। র্যাব তোমারে খুঁজে কেরে,মীরার প্রশ্নে পাপ নেই। স্বামীর ব্যবসার জগত সম্পর্কে কোনো ধারণা তার নেই। নেয়ার চেষ্টা কিংবা ইচ্ছাও ছিলো না কোনকালে। মীরাকে উন্মাদের মতো আদর করে রেহান। আদরের বাহুল্যে মীরা গত হয়ে যাওয়া দুশ্চিন্তার দিনটি ভুলে যায়। জিজ্ঞেস করতে ভুলে যায়, গত চব্বিশ ঘণ্টা কই ছিলো রেহান, কেন তার মোবাইল বন্ধ, কেন সে বাসায় একটা খবর দিলো না!
পুলিশ আব্দুল হাকিমকে যখন থানা চত্ত্বর থেকে হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যায় তখন গাছে গাছে কাকেদের তীব্র কোলাহল। ভোর ভোর রাতে ডোম চাদর তুলে লাশটা দেখায়, তার মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়া মদের গন্ধ আর মরা মানুষের বিকট গন্ধে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে থাকে আব্দুল হাকিম। সাথে থাকা পুলিশ আর মনোয়ারার ভাগিনা কোনরকমে সোজা রাখে তাকে। কোন সন্দেহই থাকেনা আব্দুল হাকিমের। পৃথিবীতে ছেলের মৃতদেহ সনাক্ত করার মতো কঠিন আর কোন কাজ আছে কিনা আব্দুল হাকিম জানেনা।এটা রেহানই। সারা চেহারা জুড়ে যদিও ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত দাগ চেহারার স্বাভাবিকত্ব বদলে দিয়েছে,কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই চেনবার মতো । তবু চুলের স্টাইল, ভ্রু গোঁফ সব রেহানের। কব্জিতে কালো আঁচিল। জন্মদাগ। আহা রেহান, এভাবে মরলি তুই! কোথায় কোন বেঘোরে! হাসপাতালের বাইরে হাত পা ছড়িয়ে নিঃসাড় বসে থাকে আব্দুল হাকিম। সন্তান হারা পিতার কী করতে হয় সে জানেনা। সারাদিন থানা পুলিশ,হাসপাতাল, নেশার আড্ডা সব খুঁজতে খুঁজতে এখন ছেলেকে পাওয়া যাওয়ার স্বস্তি নাকি ছেলে মৃত এই বিষাদ তাকে নিস্পন্দ করে দিয়েছে সে বুঝতে পারেনা।
মনোয়ারার বড়বোনের ছেলে একাই সব করে। কাগজপত্রে সই সাবুদ। পুলিশ বলতে থাকে,মামলা হবে। অপমৃত্যুর। শহরলিতে মাদকের ডেরায় লাশ পাওয়া গেছে তার। পিটিয়ে মারা হয়েছে তার আলামত স্পষ্ট। সকাল হয়ে যায় সব আনুষ্ঠানিকতা সারতে। একটা মৃত ব্যক্তির লাশ ছাড়াতে এতো আয়োজন।
মীরা কখন ঘুমিয়ে গেছে বলতে পারেনা। কান্নাকাটির আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙে তার। পাশে রেহান নেই। বাইরে এসে বিস্ময় বিমুঢ় মীরা নিজের করণীয় ঠিক করতে পারেনা। মৃতদেহ ঘিরে মনোয়ারা সহ আত্মীয় পরিজন দের মাতম। আব্দুল হাকিম বেহুশ শুয়ে আছেন মাটিতে। আগর বাতির মৃত্যু গন্ধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পুরো বাড়িতে বিছিয়ে দিয়েছে হাহাকার। দুজন বসে গেছে কোরান শরীফ খতমে। অপেক্ষাকৃত তরুণ স্বজন পরিজন রা দ্রুত দাফন কাফনের ব্যবস্থায় তৎপর। এই অবস্থায় মীরা কোন ফাক ফুসরতই খোঁজে পায়না কাকে বলবে সে রেহানের কথা। এ লাশ রেহানের নয়। রেহান বাসা থেকে গেছে ঘন্টাও হয়নি। মীরা তবু একবার বিস্রস্ত মনোয়ারার কাছে প্রানপণে বলার চেষ্টা করে এটা রেহানের মৃতদেহ নয়। হতে পারেনা। স্বামী হারিয়ে মাথার ঠিক নেই এমত সিদ্ধান্তে সবাই টেনে হিঁচড়ে শেষবার মুখখানা দেখিয়ে মীরাকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা সিটকানি দেয়।
কিন্তু গোল বাঁধে তারপরে। মাস দুই যেতে না যেতেই মীরার বমি শুরু হয়।গর্ভের লক্ষন স্পষ্ট হয়। পাঁচ মাসের সময় ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার নিশ্চিত করে, মীরা গর্ভবতী। শেষ পিরিয়ডের তারিখ হিসাব করে দেখা যায় ঠিক সেই তারিখেই। যে তারিখে রেহানের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল সেই দিনই গর্ভসঞ্চার হয়েছে তার। প্রেস্ক্রিপশনের এক পাশে লিখেও দেন তারিখটা। সম্ভাব্য ডেলিভারির তারিখ, ব্লাড সুগার, ব্লাড প্রেশার সব লেখা থাকে কাগজে। মনোয়ারা পুত্র শোকের প্রখর যন্ত্রণা আর আগত অভ্যাগতদের সাথে চোর পুলিশ খেলার ক্লান্তিতে বিপর্যস্ত তখন।
দিনে দিনে মীরার পেট ফুলে উঠে বেলুনের মতো। মীরা টের পায় ভেতরের মানব সন্তানটির সজোরে লাথি মারার আনন্দ। মনোয়ারা বারবার বারবার মীরাকে ডেকে পাশে বসান, হাছা কইরা ক আগেই পোয়াতি হইছিলি? মীরা সর্বশক্তি দিয়ে মনোয়ারাকে বিশ্বাস করাতে চায় সে মিথ্যা বলছে না। সত্যি সেদিন রেহান এসেছিল। যে লাশ দাফন কাফন দিছোইন সেইটা রেহানের নাগো আম্মা।
আব্দুল হাকিম নিজে ছেলের জন্ম আঁচিল দেখেছে। স্বজনরা দেখেছে তার মুখাবয়ব। কালসিটে পড়ে যাওয়া মুখাবয়বের ভাঁজে ভাঁজে রেহানউদ্দিন ছিলো। চুলের স্টাইলে, ঠোঁটের কোনায় রেহানউদ্দিন, রেহানউদ্দিনই লেগে ছিলো। আর মর্গে কাঁটাছেড়ার পরে যে শার্টটা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে সেটিও তো সেই শার্টটা।আগের দিন ছেলেকে, খাটাস দেখ গতরের জামাডারে কি ময়লা করছে,এর ঘিন্না পিত নাই ইত্যাদি গালি দিতে দিতে ক্ষার আর গরম পানি দিয়ে ডলে ডলে পরিষ্কার করে দিয়েছিল। মনোয়ারা বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলার পরেও কী করে কারো কোন সন্দেহ থাকে! মীরার আপত্তি কেউ তখন গুরুত্ব দিয়ে গ্রাহ্য করেনি।
সন্দেহ আর আশঙ্কার চোখ জ্বালা করা ধোঁয়ায় একসময় ছেলের জন্ম হয়। তখনই একদিন হোয়াটসঅ্যাপে কল আসে একটা আননোন নাম্বার থেকে। বাচ্চার সুতীব্র কান্নার মুখে ফুলে ফেঁপে উঠা স্তনবৃন্ত মুখে দিয়ে চুপ করিয়ে ফোনটা ধরে মীরা। রেহান। রেহানউদ্দিন। চিৎকার করে সবাইকে জানাতে চায় মীরা। অপরপ্রান্ত থেকে রেহান আবার বলে,চুপ চুপ। কাউরে কইছ না। আমি বেঁচে আছি। তোর একাউন্ট নাম্বারটা দে। কই তুমি? কই আছো? বাড়িত আও না কেরে? কোন কথার উত্তর না দিয়ে রেহান আবার তোর একাউন্ট নাম্বারটা দে বাইচ্চার খরচ পাডামু,বলেই ফোনটা কেটে দেয়। মীরার একাউন্ট নাম্বারও নেয়।
কদিন পর টাকা আসতে থাকে একাউন্ট নাম্বারে। মীরা কাউকে না বলতে পারলেও তাঁর জীবন যাপনে পরিবর্তন কারো চোখ এড়ায় না। ছেলের খরচের জন্য কারো উপর না নির্ভর করাটা সংসারের অনেক হিসাব নিকাশ বদলে দেয়। মনোয়ারা সন্দেহ তাড়িত হয়ে পুত্রশোক প্রায় ভুলতে বসে। মীরার চালচলনে তিনি মুখ আর বন্ধ না রেখতে পেরে একদিন তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেই বলেন। কই যাবে মনোয়ারা এই নাবালক পুত্র সন্তানকে নিয়ে। এই জগত সংসারে কে জায়গা দেবে তাকে! নাকের জল চোখের জল এক করে একদিন গভীর রাতে ঘটনা টা জানায় মীরা রেহানকে। তার তিনদিন পর রেহান এসে বাড়ির দরজায় টোকা দিলে মা মনোয়ারাই দরজা খুলে। মীরার চোখে চকচকে আলো দেখে মনোয়ারা ভাবে কার ছেলেরে কবর দিলো রেহানের নামে? এই কয় বছরে কেউতো খবর নিলোনা।